রাজধানীর আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ২ নম্বর সড়কের তিন তলা একটি ভবনে মানসিক হাসপাতাল ‘মাইন্ড এইড’। সেখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেয়ার নামে চলছিল বাণিজ্য। আছে সাউন্ডপ্রফ টর্চার সেল। কথিত হাসপাতালটিতে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের মারধরের মাধ্যমে নিষ্ঠুর চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা শুরু করেন হাসপাতালটির ওয়ার্ডবয় ও বাবুর্চীসহ কর্মীরা।
মানসিক সমস্যার কারণে পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে সোমবার মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যায় পরিবারের সদস্যরা। এরপর সেখানকার কর্মকর্তা কর্মচারীদের নির্যাতনে ও অমানবিক অপচিকিৎসার শিকার হয়ে প্রাণ হারান মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তা আনিস। মাস তিনেক আগে চালু হওয়া লাইসেন্সবিহীন বেসরকারি হাসপাতাটিতে সব রোগীর সঙ্গে এমন ভয়াবহ আচরণ করা হলেও সর্বশেষ ঘটনাটির শিকার যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, সেটি আঁচ করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন সেখানকারী দুজন নারী বাবুর্চী।
এদিকে রাজধানীর মাইন্ড এইড হাসপাতালে এএসপি আনিসুল করিম শিপন হত্যার ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। আর নির্যাতনে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসের মৃত্যুর ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। পুলিশ কর্মকর্তা আনিসকে পিটিয়ে হত্যার পর আইজিপির নির্দেশে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
অন্যদিকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়ে মারা যাওয়া এএসপি আনিসের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল বুধবার সকালে নিহতের গাজীপুরের কাপাসিয়ার বাসায় গিয়ে শান্তনা ও বিচারের আশ্বাস দেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি)সহ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে এ ঘটনায় গ্রেফতার মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ শারীরিক অসুস্থ থাকায় তার চিকিৎসা চলছে রাজধানীর আগাঁরগাঁওয়ের নিউরো সাইন্স হাসপাতালে। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে নিয়াজকে ওই এলাকা থেকেই গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ১১ জন। এদের মধ্যে ১০ জনকে মঙ্গলবার বিকেলে ৭দিন করে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। তাদের টানা জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ আদাবর থানা পুলিশ।
উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে নেয়া হয় আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে। এর দ্বিতীয় তলায় যে কক্ষে মারধর করা হয়, সেটির দেয়ালে ফোম লাগানো। মেঝেতে দুটি জাজিম রয়েছে। হাসপাতালের একজন কর্মচারী জানান, এটি মূলত টর্চার সেল। কোনো রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করলে ওই কক্ষে ঢুকিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হতো। কক্ষটিতে সিসি ক্যামেরা আছে।
সেখানকার দুজন নারী বাবুর্চি জানান, হাসপাতালটিতে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়া হয়। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকেন না। নতুন রোগী ভর্তি হওয়ার পর সাধারণ কর্মচারীরাই মারধর ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করেন। ঘটনার দিন সোমবার হাসপাতালটিতে ১৪ জন রোগী ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর পরপরই তারা অন্যত্র চলে গেছেন।
এএসপি হত্যায় জড়িতদের ছাড় নেই-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: রাজধানীর মাইন্ড এইড হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপন হত্যার ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। দেশে অনুমোদনহীন হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলেও জানান মন্ত্রী। সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে গতকাল বুধবার এ কথা বলেন তিনি।
জ্যেষ্ঠ এএসপি আনিসুল করিম হত্যার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওই বেসরকারি হাসপাতালটি অনুমোদন না নিয়েই পরিচালনা করা হচ্ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। হাসপাতাল পরিচালনাকারীদের পাশাপাশি অন্য কেউ জড়িত থাকলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তা ছাড়া তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে তিনি জানান।
আনিসের পরিবারের পাশে পুলিশ কর্মকর্তারা: চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়ে মারা যাওয়া, সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমের গাজীপুরের বাসায় গিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা। গতকাল সকালে ঢাকা থেকে তারা সেখানে যান। এ সময় পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদসহ তদন্ত দলের কর্মকর্তারা। সুষ্ঠু তদন্তের পর দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাস দেন ডিসি।
উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসক ছিলেন না। হাসপাতালের কর্মচারীরা চিকিৎসা দেয়ার অজুহাতে জোর করে দোতলার একটি অবজারভেশন কক্ষে তাকে নিয়ে যায়। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ওই কক্ষে নির্মম নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়।
মর্মান্তিক এ ঘটনার পর মঙ্গলবার সকালে নিহত আনিসের বাবা মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ এ ঘটনায় হাসপাতালটির চিকিৎসক ও পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদসহ ১১ জন গ্রেফতার করেছে, যার মধ্যে ১০ জনকে সাত দিন করে নেয়া হয়েছে রিমান্ডে।
তারা হলেন-মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মো. মাসুদ, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট মো. তানভীর হাসান, ওয়ার্ড বয় মো. তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, মো. লিটন আহাম্মদ ও মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ। এ ছাড়া এ মামলায় চার আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন-আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও মোছা. ফাতেমা খাতুন ময়না।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে: মামলার এজাহারে নিহতের বাবা বাদী মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমার ছেলে আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার। আমার ছেলে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) হিসেবে কর্মরত ছিল। গত তিন-চার দিন ধরে হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যায়। পরিবারের সবার মতামত অনুযায়ী তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য গত সোমবার সকালে প্রথমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাই। অতঃপর আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য একই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আরিফ মাহমুদ জয়, রেদোয়ান সাব্বির ও ডা. নুসরাত ফারজানা আনিসুল করিমকে হাসপাতালে ভর্তির প্রক্রিয়া করতে থাকেন।
ওই সময় আমার ছেলে হাসপাতালের সকল স্টাফের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করে। হাসপাতালের নিচতলায় একটি রুমে বসে হালকা খাবার খায়। খাবার খাওয়ার পর আমার ছেলে ওয়াশরুমে যেতে চায়। বেলা পৌনে ১২টার দিকে আরিফ মাহমুদ জয় আমার ছেলেকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হাসপাতালের দোতলায় নিয়ে যায়। তখন আমার মেয়ে উম্মে সালমা আমার ছেলের সাথে যেতে চাইলে আসামি আরিফ মাহমুদ জয় ও রেদোয়ান সাব্বির বাধা দেয় এবং কলাপসিবল গেট আটকে দেয়। তখন আমি, আমার ছেলে রেজাউল করিম ও মেয়ে ডা. উম্মে সালমা (সাথী) নিচতলায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। এরপর এজাহারে উল্লেখিত আসামিসহ আরো অজ্ঞাতনামা কয়েকজন আমার ছেলে আনিসুল করিমকে চিকিৎসার নামে দোতলার একটি অবজারভেশন রুমে (বিশেষভাবে তৈরি কক্ষ) নিয়ে যায়।’
এজাহারে আরো বলা হয়, ‘আসামিরা আমার ছেলেকে চিকিৎসা করার অজুহাতে অবজারভেশন রুমে মারতে মারতে ঢুকায়। তাকে উক্ত রুমের ফ্লোরে জোরপূর্বক উপুড় করে শুইয়ে তিন-চারজন হাঁটু দ্বারা পিঠের উপর চেপে বসে, কয়েকজন আমার ছেলেকে পিঠ মোড়া করে ওড়না দিয়ে দুই হাত বাঁধে। কয়েকজন আসামি কনুই দিয়ে আমার ছেলের ঘাড়ের পিছনে ও মাথায় আঘাত করে। একজন মাথার উপরে চেপে বসে এবং আসামিরা সকলে মিলে আমার ছেলের পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্নস্থানে উপর্যুপরি কিল ঘুষি মেরে আঘাত করে।
আরো বলা হয়, এরপর দুপুর ১২টার দিকে আমার ছেলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যা হাসপাতালে স্থাপিত সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজে দৃশ্যমান। নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পর আসামি আরিফ মাহমুদ জয় নিচে এসে আমাদের ইশারায় উপরে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়। আমি আমার ছেলে ও মেয়েসহ অবজারভেশন রুমে গিয়ে আমার ছেলেকে ফ্লোরে নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাই। অতঃপর জরুরি ভিত্তিতে আমার ছেলেকে একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে আমার ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন।’
এজাহারে আরো বলা হয়, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগীর চিকিৎসা দেয়ার নামে অর্থ উপার্জনের একটি অনুমোদনহীন অবৈধ এবং অসৎ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। এজাহারের ১১ হতে ১৫ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত আসামিদের ব্যবস্থাপনায়, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্ররোচণায় ১ থেকে ১০ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত আসামিরাসহ তাদের কয়েকজন অজ্ঞাতনামা সহযোগী আসামিরা পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে চিকিৎসা দেয়ার নামে অবজারভেশন রুমে নিয়ে শরীরের বিভিন্নস্থানে উপর্যুপরি আঘাত করে মৃত্যু ঘটায়।’