রূপকল্পটিও যথেষ্ট প্রগতিশীল। সেখানে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকারের পাশাপাশি জনগণের সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সেবাপ্রাপ্তির সাম্য, লিঙ্গসমতা, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সামষ্টিক উন্নয়ন।
এ রূপকল্পে সেই দিকটিও স্বাস্থ্যনীতিপ্রণেতাদের নজর এড়ায়নি; তাঁরা দারিদ্র্য নিরসনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে সবার জন্য প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা, সমতা, সেবার মান, সহজপ্রাপ্যতা, রোগ প্রতিরোধ, মানবাধিকার ও মর্যাদার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। অতি জরুরি কোনো বিষয় বাদ পড়েছে, এমনটি বলা যাবে না।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে চিকিৎসার পাশাপাশি স্থান পেয়েছে জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিস্থাপনযোগ্য জন–উর্বরতা অর্জন, মা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, চিকিৎসাশিক্ষার মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্য তথ্যপ্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সহজলভ্যতা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিকল্প চিকিৎসার (ইউনানি, আয়ুর্বেদীয়, হোমিওপ্যাথি) উন্নয়ন। ‘জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পৃক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা নিশ্চিত করা’ (চতুর্দশ ধারা)। এসব ধারা থেকে বোঝা যায়, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা তথা ক্লিনিক্যাল ট্র্যাক যে পৃথক, তার স্বীকৃতি স্বাস্থ্যনীতিতে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখনকার অনেক ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও এটি সম্যক অনুধাবন করেন না। হয়তো সে কারণেই এত বছরেও আমরা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনস্বাস্থ্যের জন্য পৃথক কোনো ট্র্যাক দেখতে পাচ্ছি না, যার তীব্র প্রয়োজনীয়তা এই কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
‘মূলনীতি’ এবং ‘চ্যালেঞ্জসমূহ’ অংশে যে বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে, তা আজ প্রায় এক দশক পরও তামাদি হয়ে যায়নি, বরং সেগুলো দারুণভাবে সাম্প্রতিক। অসংক্রামক রোগ, নতুন রোগের আবির্ভাব ও পুনরাবির্ভাব, জলবায়ুর পরিবর্তন, নগরস্বাস্থ্য, জনমিতিক অবস্থান্তর, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য গবেষণা, রোগতাত্ত্বিক পরিবীক্ষণ—এমন অনেক বিষয়কে সংক্ষেপে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘কর্মকৌশল’ অংশের প্রথম পয়েন্টটি প্রণিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠন করা হবে। এ কাউন্সিল সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বেসরকারি খাতের স্টেকহোল্ডার এবং এ–সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কাউন্সিল স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।’
আজ প্রায় এক দশক পরে, কোভিড অতিমারির মারণযজ্ঞের বিনাশপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, কোথায় সেই জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল?